ড. মো. আখতারুজ্জামান; ২৭ মে, ২০২০ খ্রি.
বিদ্যুতিনের এই জামানায় অন্তর্জাল জগতে যারা বুদ হয়ে পড়ে থাকা নেটিজেনদের বেশিরভাগের বয়স আমাদের মত মানুষদের পুত্র বা কনে সম বা তদাপেক্ষা আরো কম। এদের মধ্য একটা অংশের আচরণ বিচরণ মার্জিত, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও নেটিজেনদের আরেকটি অংশ তাদের নিজেদের মনের মত বেছে নেয়া পথকেই সবচে সঠিক পথ বলে মনে করে। ওদের কাছে ওদের বোধবুদ্ধিটুকুই ষোলোআনা, বাকিটা মিথ্যে। সামাজিক মাধ্যমে এদের সতত বিচরণ! এ মাধ্যম বড় এক আজব প্লাটফর্ম। এই মাধ্যমটি ভাল না খারাপ সেটা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। তবে এটি আপনাকে যতটা উপরে তুলতে পারে তার থেকে নিচে নামাতে পারে ত্বরিত গতিতে। এই মাধ্যমের ঋণাত্মক শক্তি মারাত্মক! আপনাকে এখানে বিচরণ করতেই হবে তেমনটি কিন্তু নয়; তবে আপনি যদি এই মিডিয়ায় বিচরণকারী তথাকথিত বন্ধুদের কোপানলে একবার পড়েছেন, তাহলে ওরা আপনাকে টুকরা টুকরা করে কুপিয়ে চামড়া তুলে দগদগে ক্ষতস্থানে লবণ লাগিয়েই ছাড়বে। তিলকে তাল করতে ওরা ভারি পারঙ্গম! আপনার সব প্রাপ্তিকে নিমিষে ম্লান করে ওরা আপনার ব্যবচ্ছেদোত্তর নগ্ন হোলি খেলায় মেতে উঠবে। শুড়ের সাক্ষী মাতালের মত এই দলের এক নেটিজেন আরেক নেটিজেনকে অসুস্থ বিনোদন হাঁকিয়ে বলবে, “ব্যাটাকে আচ্ছামত দিয়েছি..!” পিতৃতুল্য বা মাতৃসম মানুষদেরকে অপমান করে এরা খুব অশ্লীল আনন্দ উপভোগ করে। মুরুব্বিদের অপমান করে এরা খুশিতে ঢেঁকিতে আনন্দ নাড়ু কুটতে থাকে। নিজস্বী জামানার এসব তরুণের তারুণ্য শক্তি অসীম! ওরা আগ পাছ কিছু ভাবে না। এরা ক্লোজ সার্কিটে বসে তারা নিজে যা নয় তার থেকে অনেক বেশি প্রকাশ করে থাকে। এরা সম্মানীয় মানুষদের সম্পর্কে আদ্যপান্ত না জেনে তাদের সম্পর্কে যে ভাষা ব্যবহার করে, সেসব ভাষা কেউ যে আজীবনের তরে আপনার আমার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে সেটা কল্পনাতে না আসলেও ওরা সেটা অবলীলায় করে এবং এটা করে তারা তাদের অনাসৃষ্টি সুখের উল্লাসেই মেতে ওঠে! কী অসুস্থ বিনোদন! এমন অবস্থার শিকার হলে আপনার সকল অনুনয় বিনয় এবং অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্যে বারংবার করজোড়ে ক্ষমার আবেদনও অরণ্য রোদনে পর্যবসিত হবে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আর হতবাক হয়ে, মুখে কুলুপ এঁটে, দৃকযুগল মুদিত করে সহ্য করা ছাড়া আর কিচ্ছুটি করার থাকবে না। এখানকার যে মানুষগুলো আপনাকে পোস্টমর্টেম করবে যোগ্যতা দক্ষতায় ওরা কিন্তু কস্মিনকালেও আপনার ধারে কাছেও যেতে পারবে না। ওদের মনোগত উন্মাদনা ও উন্মত্ততার স্বরূপ বড্ড ভয়ঙ্কর!
বিদ্যুতিন যুগের এসব তরুণ নেটিজেনদের সাথে কিছু জ্ঞানপাপী অবসরপ্রাপ্ত বুড়োরাও ওদের হুক্কাহুয়া রবের সাথে সুর মেলায়ে ভারি মজা পায়। এসব প্রবীণরা সদ্য ঐ জগতের সাথে মেলবন্ধন রচনা করে নিজেদের খানিকটা স্মার্ট বানানোর জন্যেই কিছু স্পর্শকাতর মন্তব্য করে ভারি আনন্দ পায়। এরা বড্ড্ বোকা! না জেনে না বুঝে হুদাহুদি ফালাফালি করেন।
তথাকথিত এসব নেটিজেনরা জটিল চরিত্রের ধ্বজ্বাধারী এক আজব মনুষ্য সন্তান! ওপেন না ক্লোজ প্লাটফরমে আপনার বিরুদ্ধে কাঁদা ছুঁড়াছুঁড়ি হবে সেটা বিষয় না। যে মিডিয়াতেই হোক না কেন সেটার উত্তাপ কিন্তু ঠিকমত আপনার গায়ে লাগবে। আরো মজার ব্যাপার হলো এখন বিচরণকারিরা টার্গেট করবে আপনার খুব কাছের মানুষকে। তাদের কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে আপনার সম্পর্কে ওদের কানে গরম শিশা ঢেলে তাঁদেরকে উত্যক্ত করতেই থাকবে। আপনার সামান্য অনিচ্ছাকৃত ভুলকে তিলকে তাল বানিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করবে; ফলে, আপনার সেই শুভাকাঙ্খী মানুষগুলো রাতারাতি আপনার তথাকথিত শুভাকাঙ্খীতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। আপনার ভুলের মাত্রা কতটা তীব্রতর বা জনস্বার্থ পরিপন্থী বা নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত কিনা, সেসব দেখবার সময় নেই। আপনার গোটা জীবনের সব প্রাপ্তি নেটিজেনদের কাছে ধরাশায়ী হয়ে আপনার সততা নিষ্ঠার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ঢুকরে ঢুকরে কাঁদতে থাকবে। এমন দুঃসময়ে দেখবেন আপনার পাশে কোন মানুষ নেই। সবাই আপনার পক্ষ ত্যাগ করে ত্বরিত আপনার বিপক্ষে অবস্থান করবেন। এদের মধ্যে কদাচিৎ দু’একজন কিঞ্চিৎ আপনার পক্ষাবলম্বন করলেও তারা ঐসব নেটিজেনদের সম্মিলিত শক্তির কাছে পরাভূত হয়ে মৌনতার পথ অবলম্বন করতে বাধ্য হবেন। এমনতর ধুরন্ধর আর কুলাঙ্গার নেটিজেনদের কবলে পড়ে সোজা সরল মানুষগুলোকে একেবারে গিরিখাদের তলায় চলে যাওয়ার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি! তাই এমন ভাবলেশহীন অবস্থার মুখোমুখি যেন হতে না হয় সে বিষয়ে আমাদের মত হাবাগোবা আর বুড়ো ভামদের অনেক বেশি সাবধানি হতে হবে।
তবে সময় সব রকমের সাবধান থেকেও এঁদের থেকে নিস্তার পাওয়া মুষ্কিল। এক্ষেত্রে আপনার আমার ভাগ্যও একটা ফ্যাক্টর বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি! তবে এদের জন্যে একটা মারাত্মক অশনি সংকেতের বার্তা রয়েছে। সামাজিক মাধ্যমের ক্লোজ সার্কিটে এদের স্ব স্ব মতামত রাখতে গিয়ে ওরা ওদের নিজেদের অজান্তে সেখানে এমন কিছু ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক সিগন্যাল রেখে আসছে, যেটা একসময় ভুক্তভোগী কারুর শক্তিশালী ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সাথে এমনভাবে লিঙ্কড্ হয়ে যেতে পারে যেখান থেকে নিজেকে আর অবমুক্ত করতে পারবে না। তখন কেবলই মনে হতে পারে, কোনবা পথে নিতাইগঞ্জে যাই….। নিতাইগঞ্জে যাবার পথ আর তখন তারা খুঁজে পাবে না!
প্রিয় সুজনেষু, আমাদের সকলেরই মনে রাখা উচিৎ কল্পিত বিশ্বে গোপন বলে কিছু নেই। আপনি একবার সেখানে আপনার ‘জিরো ওয়ানের’ সিগন্যাল রাখলেন তো আপনি কট্; পরে বোল্ড আউট হবেনই! অতএব, ঐ সব অসুস্থ অশ্লীল উল্লাসে মাতোয়ারা তমিজহারা নেটিজেনদের বলবো, “এখনো সময় আছে বাছারা সাবধান হও! নইলে কোন এক কুক্ষণে এমন ফাঁটা বাঁশে আটকাবে, সেখানে থেকে আর বেরুতে পারবে না। সবাই তো আমাদের মত নাদান আর হাদারাম নন; সুতরাং যেকোন সময় ধরা খেয়ে যাবে! মনে রেখো পাপ কিন্তু নিজের বাপকেও ছাড়ে না। তোমার অপকর্মের সিংহভাগ সাজা তোমার জীবদ্দশাতেই হয়ে যাবে। অতএব…….!
সেইসাথে দেশ জাতি সমাজের জন্যে যেসব নেটিজেনরা নিরন্তর প্রচারবিমুখ হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ভালবাসা ও অফুরান শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।