বহুরূপী মানুষের ভয়ঙ্কর উন্মাত্ততা আমি দেখেছি!
……..ড. মো. আখতারুজ্জামান
আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ। অল্পতেই আজীবন তুষ্ট থেকেছি, এখনো তুষ্ট আছি। সুযোগের ঋণাত্মক সদ্ব্যবহার করলে হয়ত আজ আরো কিছু অর্থবিত্তের মালিক হতে পারতাম, কিন্তু নীতি নৈতিকতা আদর্শিক কারণে সেটা করতে পারিনি। তাতেও কোন দুঃখবোধ নেই, কারণ যা পেয়েছি সেইটুকুতে খুশি আমার মন।
একটা সময় সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক লেখালেখি করতাম; কিন্তু এখন আর লিখতে পারিনা। কলম দিয়ে লেখা তো অনেক আগেই ছেড়েছি; নোটপ্যাডে লেখার যে শক্তি ছিল সেটাও হারিয়ে গিয়েছে; ফ্রোজেন শোল্ডারে আড়ষ্ট হয়ে আছে আমার লেখনি শক্তির আঁধার তর্জনী, মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুল। আঙুলগুলো কখনো একটু সচল হতে চাইলেও মস্তিষ্কের পক্ষাঘাতগ্রস্ত নিউরন কোষ কলা আমার লেখ্য ভাবনাগুলোকে সুবিন্যস্থ করতে দেয় না; সব কেমন যেন এলোমেলো করে দেয়; বদলে যায় আমার লেখার স্বাভাবিক গতিধারা ও প্রতিফলন!
আঘাতে আঘাতে আমার মন ও মনন এখন রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত!
কিন্তু না!
এটা তো রাতারাতি হয়নি! আশরাফুল মাখলুকাতের নানাবিধ খড়গ আমাকে দিনের পর দিন বহুভাবে আঘাত করে এ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। তাই আজ আমি অক্ষম অধম চলৎ শক্তিহীন একজন অথর্ব মানুষ!
মাঝে মাঝে নিঠুর নিয়তিকে জিজ্ঞেস করি, কি আমার অপরাধ?
মানুষকে বেশি ভালবাসাটাই তবে কি আমার অপরাধ?
বিনে পাপে কেন আমার জীবনে এই গুরুদন্ডের প্রাপ্তিযোগ?
নিজের স্বীয় বিবেকের আদালতে বারবার প্রশ্ন করেও এটার কোন সদুত্তর পাইনি!
মানুষের ভয়ঙ্কর রূপের উন্মাত্ততা কতটা তীব্রতর হতে পারে, সেটা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি; উপলব্ধি করে কষ্ট পেয়েছি নিজে নিজেই; কাউকে বলার মত কাছে পাইনি; তিলেক দন্ড সান্ত্বনা দেবার মত কোন মানুষও কাছে আসেনি। যাদেরকে খুব নির্ভরশীল ও কাছের মানুষ মনে করতাম, তাদের সবাইকে নিমিষে আমার বিপরিতে অবস্থান নিতে দেখেছি। যাকে বা যাদেরকে আপনজন মনে করতাম ওরা আমার বিপদে তামাশা দেখেছে, আমার দিকে কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেইনি।
একটা সময় বেশ করে বুঝতে পারলাম আপনার আমার জ্ঞান বুদ্ধি যোগ্যতা দক্ষতা মেধা মননশীলতার এক কানাকড়িও দাম নেই!
আপনি আমি তো একেকজন মানুষ মাত্র; অতিমানব, মহামানব বা ঠাকুর দেবতা নই! তাই একটু আধটু ভুল আমাদের তো হতেই পারে। হতে পারে সে ভুল আপনার আমার কর্ম কথা আচরণ বিচরণ বা লেখনিতে। কারণ মানুষ মাত্রেই তো ভুল হয়।
Slip of tongue বা Slip of pen হয়েছে তো আপনি আমি বিনম্র ক্ষমাপ্রার্থনা করেও কূল পাব না। আপনার আমার গোটা জীবনে যত বড় বড় প্রাপ্তিই থাকুক না কেন, নিমিষেই এক ফুৎকারে আমাদের সকল ভাল কর্মের প্রজ্জ্বলিত শিখাকে জোর করে নিভিয়ে দেয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করবে আমাদের তথাকথিত সুজন বন্ধুরা।
কী অসাধারণ আশরাফুল মাখলুকাত আমরা!
আপনি যাদেরকে খুব কাছের আপনজন মনে করেন, একটা সময় ঠিক টের পাবেন তারা কেউ আপনার কাছের নন; যাদেরকে মুরগীর বাচ্চার মত গোটা জীবনে আদরে আদরে আগলে রেখেছিলেন, দেখবেন আপনার দুঃসময়ে ওগুলো সব একেকেটা বাদরে পরিণত হয়েছে।
আল্লাহ না করুণ যদি আপনার স্বাভাবিক যোগ্যতা অপেক্ষা খানিকটা বেশি যোগ্যতা বা দক্ষতাকে কোন না কোনভাবে জনসমক্ষে মেলে ধরতে পারেন তাহলে আপনার ভাল কাজকে নিন্দুকেরা অপব্যাখ্যা করে আপনাকে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে ছাড়বে না।
প্রকারন্তরে আপনার যদি উচ্চতর শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতার কোন ভাল সনদ থাকে তাহলে আপনার সেই সনদ প্রদানকারি প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত নিন্দুকেরা তুলোধোনা করে ছেড়ে দেবে।
অথচ যারা আপনাকে ধুনকার হিসেবে এমন তুলোধুনা করছেন ওদের এমন কিছু নেই, যা দিয়ে গোটা জীবনে ওরা আপনার সমকক্ষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সনদ বা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন!!
পাথর সময় আমাদের জীবনে কখন কিভাবে আসবে সেটা তো ভবিতব্যের কাছেই বন্দি। তাই আমাদের বর্তমান প্রাপ্তিকেই অধিক মনে করে ভাল থাকতে হবে। বর্তমান যেই না অতীত হলো সেদিকে আর ফিরেও তাকানো যাবে না; তাকালে নিকষ কালো অমানিশার আঁধার ছাড়া কিছুই দেখা যাবে না!
মনে রাখবেন, যারা এক সময় আপনাকে স্তুতি আর স্তাবকতায় ভরে রেখেছিলেন, যারা আপনার জন্য এক সময় জান কোরবানী করতে প্রস্তুত ছিলেন, আপনার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবার সাথে সাথে ওরা আপনার জান কবজ করতেও এতটুকু দেরি করবে না। মীরজাফর আর খন্দোকার মোশতাকের প্রেতাত্মারা অমর! ওরা আমাদের মাঝেই ঘাপটি মেরে বসে আছে। ঝোপ বুঝে কোপ মেরে আপনাকে আমাকে কতল করে ছেড়ে দেবে!
একজনকে প্রশংসা করতে গেলেও হিসেব কষে দেখবেন, আপনার প্রশংসা অন্যের আঁতে ঘা লাগার কোন কারণ হচ্ছে কিনা?
এখানে ভুল করলেও চোখের পলকে অধঃপতনের অতল গহবরে পৌঁছে যাবেন।
আবার আপাদমস্তক ভাল মানুষের খোলস পরে যারা বসে আছে ওদের থেকে সাবধান! ওটা ওদের ভন্ডামি!সময়কালে আপনি ওদের স্বরূপটা ঠিক বুঝতে পারবেন।
স্তুতি স্তাবকতাকে পাত্তা দেয়ার দরকার নেই, তবে সেসব আমলে নিয়ে যাচাই বাছাই করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। যারা স্বার্থসিদ্ধির জন্যে আপনার শরীর ও মনের উপরে তেলাতেলির বন্যা বইয়ে দেয় ওদের থেকে সাবধান!
খুব সাবধান! এটা আমার নিজের জীবনের শিক্ষা। জীবন থেকে নেয়া , দেখা ও শেখা!
সরকারি চাকুরিতে পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে আর্টিকেল ফোট্রি সেভেনে দায়িত্ব হস্তান্তর মানেই আপনার ঐ কর্মস্থল আপনার কাছে অন্ধকার অতীত। জানবেন, ওখানে আপনার কেউ নেই কারণ Nobody salute the setting sun, everybody salute the rising sun!
প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে আপনার অধীন কাউকে আপনি পূর্ণমাত্রায় খুশি করাতে পারবেন না, এটাই চিরায়ত সত্যের অবিকল প্রতিলিপি।
যদি কোন কর্মস্থলে আপনার কিছু সফলতা থেকেই থাকে তাহলে সেটার ফল ওখান থেকেই ঘরে তুলতে পারলেন তো ভাল নইলে সেটা বুমেরাং হয়ে আপনাকে প্রতিঘাত করবেই!
একইভাবে, সৃষ্টিশীল বা উদ্ভাবনীমূলক কিছু করেছেন তো সেটা আপনার কর্মকালে ওখানেই শেষ করে আসতে হবে, আপনার অবর্তমানে আপনার সেই উদ্ভাবনকে বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করবে তারাই যারা এক সময় তোষামোদে তোষামোদে সেসব উদ্ভাবনী কাজ করার জন্যে আপনাকে পুনঃ পুনঃ উদীপ্ত করতেন।
চাকুরির কর্মস্থলে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আপনার অধীন খুব কম সহকর্মী বা অধীনদের খুঁজে পাবেন যারা আপনার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা বা ভালবাসার পূর্ণ রূপায়নটুকু আপনার গোটা জীবন অব্দি অগ্রায়ন করবে। যদি এমনটি আপনার ভাগ্যে জোটে তাহলে তো আপনার ভাগ্য অনেক ভালই বলতে হবে।
তবে, এতকিছুর পরেও অপ্রত্যাশিতভাবে, নিউটনের তৃতীয় সূত্রের আদলে এমন কিছু ভাল মানুষের দর্শন অনাহুতভাবে পেয়ে যাবেন, যাদের ভক্তি শ্রদ্ধা ভালবাসা আপনার অতৃপ্ত আত্মাকে একটু হলেও তৃপ্ত করবে।
রাত যত গভীর হয়, ভোরের আলো ততই কাছে চলে আসে, তাই আপনার জীবনে যদি ভাল কোন প্রাপ্তিযোগ থেকেই থাকে তাহলে সময়ে সেটা কোন না কোন সময় মূল্যায়িত হবেই।
আমার গুণবতী প্রয়াত মা বলতেন, কারুর পাপের শাস্তি নাকি তাঁর জীবদ্দশাতেই হবে যায়। আমি তো অতি নগন্য একজন মানুষ। আমি আমার জীবনে এই সত্যটা খুব কাছ সত্য বলে প্রতিভাত হতে দেখেছি। দেখেছি আমাকে অন্যায়ভাবে আহত করে কেউ সুখলাভ করতে পারিনি; ওদের প্রায়শ্চিত্ত ওদের জীবনকালেই হয়েছে। প্রকারন্তরে আমি তো বেশ আছি!
ন্যাচারাল প্যানিশমেন্ট বলে যে কথাটি সতত প্রবাহমান, তার মুখোমুখি হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
তাই আসুন বিপদকে ভয় না পেয়ে, দৃঢ় মনোবল নিয়ে সতত ও নিষ্ঠার সাথে সমুখে এগিয়ে যেয়ে ঐ নরকাসুরদের শেষাঙ্কের শেষ দৃশ্যপটটি দেখার প্রহর গুণতে থাকি।
আমাদের বিজয়ের জয়রথ দেখে ওরা ঠিকই একদিন ঢুকরে ঢুকরে কাঁদবে!
সেই সুদিনের প্রত্যাশায়!
২৬ মে. ২০২০ খ্রিস্টাব্দ।