- আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ, গ্রামের আর দশটা পরিবারের মতই খুব সাধারণ পরিবার থেকে আমার এই অব্দি উঠে আসা। সুতরাং এটা নিয়ে বাগাড়ম্বর করার কিছু নেই। সর্বোপরি নিজের শিকড়কে ভুলে যাওয়াটা আত্ম প্রবঞ্চনারই নামান্তর! সুতরাং আমার জ্ন্ম পরিচয় নিয়ে লুকো ছাপার কিছু নেই।
- আমার দাদা মরহুম শেখ মোজাম আলী, খুব বেশি লেখাপড়া জানতেন না;,তবে তিনি গ্রামের একজন গণমান্য মানুষ ছিলেন। আমাদের বিশাল দুর্বাচারা গ্রামে আমার দাদার একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। দাদার অনেক জায়গা জমি ছিল,সেইসাথে দাদা ভূষি মালের ব্যবসা করতেন এবং দুর্বাচারা বাজারে আমাদের একটা বড় দোকানও ছিল। দাদা সুঠাম ও নিটোল দেহের অধিকারী ছিলেন, তিনি ১১০ বছর বেঁচে ছিলেন। দাদা ১৯৭৭ সালের সম্ভবত ১৪ ফেব্রুয়ারীতে মারা যান। মৃত্যুর বছর খানেক আগেও আমার দাদাকে ছোট হাত কোদাল দিয়ে জমি কোপাতে দেখেছি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার দাদার মুখে অনেকগুলো দাঁত ছিল। আমার দাদার প্রশাসন ছিল বড্ড কঠিন। আমার বাবা আমার দাদাকে ‘বাপজান’ বলে ডাকতেন। দাদা যথেষ্ট পরোপকারী ছিলেন,সেইসাথে যথেষ্ট সামাজিক এবং বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ ছিলেন। মানুষজনকে যথেষ্ট আদর যত্ন করে খাওয়াতে তাঁর জুড়ি ছিল না।
- আমার দাদা বিয়ে করেছিলেন আমাদের নিকটবর্তী শ্যামপুর গ্রামে। আমার বাবা এবং বড় ফুফুর জন্মের পরে আমার দাদী পরপারে চলে যান। এরপর দাদা তাঁর দুর সম্পর্কের এক শালীকে বিয়ে করেন। ফলে আমরা দাদী বলতে যাকে জানতাম তিনি হলেন আমার দাদার ২য় স্ত্রী।দাদার পরের পক্ষে একজন চাচা ও দুজন ফুফু জন্ম নেন। দাদী সম্ভবত ১৯৮৮/৯৯ সালের দিকে দাদী মারা যান, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম। দাদী আমাদের খুব আদর করতেন।আমার নামটি দাদী উচ্চারণ করতে পারলেও আমার ছোটভায়ের নাম আর শিখতে পারিনি, কানে সমস্যা হওয়ার জন্যে।
- দাদার কাছে থেকে আমি আমার বংশলতিকার একটা মজার তথ্য পেয়েছিলাম, যা আমাদের পরিবারে আমি ছাড়া আর কেউ জানে না: সেটা নিচে দেয়া হলো:
- (১) আমার নামঃ কৃষিবিদ ড. মো. আখতারুজ্জামান।
- (২) আমার বাবার নামঃ শেখ মোঃ মুনসুর আলী।
- (৩) আমার দাদার নামঃ মোঃ মোজাম আলী শেখ।
- (৪) আমার বাবার দাদার নামঃ মোঃ মিয়াজান আলী শেখ।
- (৫) আমার দাদার দাদার নামঃ মোঃ গোলাম(গোল) মামুদ শেখ।
- (৬) আমার বাবার দাদার দাদার নামঃ মোঃ আমু মামুদ শেখ।
- (৭) আমার দাদার দাদার দাদার নামঃ মোঃ পরশউল্লা মামুদ শেখ।
- আমার বাবা, প্রয়াত শেখ মুনসুর আলী:তাঁর কর্মজীবনের প্রথমদিকে একজন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক ছিলেন,এরপর চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ,আমার দাদার পৈতৃক ব্যবসা এবং আমার দাদার সম্পত্তি দেখাশুনা করতেন। আমার বাবার শরীর স্বাস্থ্য বরাবরই ভাল ছিল,তেমন রোগ বালাই তার মধ্যে কখনো দেখিনি।আমাদের বুদ্ধি হয়ে দেখেছি তার চুল সাদা এবং মাথায় চুলের পরিমান কম,তবে টাক ছিল না। বাবা নামাজ পড়তেন পাঁচ বেলা এবং আমরা দেখেছি তিনি সর্বদাই মাথায় টুপি দিয়ে চলতেন এবং তার পছন্দের পোশাক ছিল পাজামা আর পাজ্ঞাবী। বাবা খুব বেশী পান খেতেন এবং অনেক আগে বিড়ি সিগারেট ও হুক্কা খেতেন। হুক্কা থাকত মেঝেতে,মা তামাক সেজে দিতেন আর তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে কড়াৎ কড়াৎ শব্দে সেই হুক্কা টানতেন মনের আনন্দে।বাবা বিয়ের সময় উপহার হিসেবে একটা পিতলের হুক্কা পেয়েছিলেন।
- দেশে স্বাধীনের আগেই বাবা ধুমপান ছেড়ে দেন। ধুমপান ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে তার এক মজার কাহিনী আছে। বাবার কাছে শুনেছি,আমাদের গ্রামের অদুরবর্তী পান্টি বাজারে বাবা কোন একটা কাজে গিয়েছিলেন ; সেখানে যেয়ে যোহরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে টুপি মাথায় দিয়ে একটা সিগারেট ধরান ; এ দৃশ্য দেখে ঐ মসজিদের ইমাম বলেছিলেন,“আপনার নুরানী চেহারা,সুন্নতী লেবাজ, এই খারাপ নেশাটা একটু ছেড়ে দিলে হয়না?” ব্যস ঐ যে সেখান থেকে তিনি তওবা করলেন আর কখনো বিড়ি,সিগারেট বা হুক্কাতে টান দেননি। এরপর বাবা নেশা হিসেবে পান সেবন শুরু করেন।
- আমার বাবা অন্যতম একটা ভাল কাজ করে গেছেন; সেটা হলো একটা মসজিদ নির্মানের গোড়াপত্তন;আমাদের গ্রামের বাজারে। মনে আছে, আমার বাবা ১৯৭৬/৭৭ সালের দিকে আমাদের গ্রামের হাটে ঘুরে ঘুরে এবং ধানের মৌসুমে আশপাশের লোকজনদের বাড়ি বাড়ি যেয়ে মসজিদের জন্যে ধান সংগ্রহ করতেন। বাবার সেই গোড়াপত্তন করা মসজিদই আজকে আমাদের দুর্ব্বাচারা বাজারের সবচে বড় এবং একমাত্র মসজিদ । আজও এলাকার মানুষজন আমার বাবার সে কীর্তি কে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকে।বাবা দেহ ত্যাগ করেন ০৫.০৯.১৯৯৯ তারিখে।
- আমার মা(বেগম আফজুন্নেসা আলী): কোনদিন স্কুলের চৌহদ্দি না মাড়ালেও অসম্ভব মেধাবী আর ভাল মানুষ ছিলেন আমার মা। তাঁর গুণ বলে শেষ করা যাবেনা।মা ইহধাম ছেড়েছেন ০৯.০৩.২০০৬ তারিখে।
- আমরা ছয়ভাই এক বোন; আমি হলাম Last but one, অর্থাৎ শেষের জনের আগেরটা। আমাদের ছয় ভায়ের মধ্যে চারজনই চাকুরিরত; মেজ ভাই চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন, আর আমি, আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই এবং আমার ছোট ভাই এই তিনজনে চাকুরিতে আছি।
- বড় ভাই গ্রামে থেকে, পৈতৃক জায়গাজমি দেখাশুনা করেন, সামাজিক ব্যবসা ও সমাজকর্ম নিয়ে আছেন।
- মেজভাই পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের চাকুরি থেকে বছর দুয়েক আগে অবসর নিয়েছেন।
- সেজভাইও বড় ভায়ের মত পৈতৃক জায়গাজমি দেখাশুনা ও সমাজকর্ম নিয়ে আছেন। সেজভাই আমাদের আমাদের বাড়ির আঙিনায় নির্মিত “শেখপাড়া জামে মসজিদের” অন্যতম খাদেম হিসেবে জনপ্রিয়তার সাথে এবং আগ্রহভরে তাঁর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
- নোয়া ভাই(চার নম্বর ভাই) বিএডিসিতে কর্মরত থেকে গত বছর (২০১৯) অবসর নিয়েছেন।
- এরপরে আমার একমাত্র বোন। সে কিনা সড়ক দুর্ঘটনায় নির্মমভাবে মারা যান ৩১.০৮.২০০৮ সালে।
- এরপরে ৬ষ্ঠ অবস্থানে আমি ।
- সবশেষে আমার তথ্য প্রযুক্তিবিদ ছোট ভাই কামরুজ্জামান, যে কিনা আমার তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞান-গরিমার অন্যতম রূপকার ও সহায়তাকারী। ওর সহায়তায় আমি আজকে তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে এতটা জ্ঞানার্জন করতে পেরেছি এবং ওর সহায়তার কারণেই এই ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স সহ মাস্টার্স করে বর্তমানে বিডিকম অনলাইন লিমিটেডে (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার কোম্পানী) চীফ টেকনিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্মরত।
- আমি ও আমার শিক্ষা:
- বরাবরই আমি একটু ভিন্ন মানসিকতা নিয়ে বড় হয়েছি।আমার বিশেষ ধরনের চারিত্রিক কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেটা আমার ভিন্ন আলোচনায় ফুটে উঠবে। কোনকালেই খুব ভাল ছাত্র ছিলাম এটা বলা যাবে না। তাই কোনমত করে এই পর্যন্ত উঠে আসা।
- আমরা যে সময়ে যে পরিবেশ থেকে আজ এতদুর অব্দি এসেছি সেটা অনেকটা ভাগ্যই বলা চলে। আমার বাবা প্রথম জীবনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকলেও সংসারী বিবাগী এই মানুষটি বরাবরই একটু সংসারের প্রতি উদাসীন ছিলেন, ফলে বাবা আমাদের পড়া লেখার ব্যপারে তেমন একটা খোঁজ খবর রাখতেন না; তাই কোনমত করে আজকে অনেকদুর এসেছি।
- ছোটবেলায় তেমন পড়ালেখা করতাম না, বাবার অনেক জমি জায়গা ছিল, বাজারে সে সময়ে অনেক বড় দোকানও ছিল। রাগ করে প্রায়ই বাবা বলতেন,“তোকে আর পড়াবো না”, আমিও খুশিতে বাকবাকুম থাকতাম। তিন ক্লাস কোনমত পাশ করে, চতুর্থ শেণিতে ওঠার পরে দেশে শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। পড়ালেখা লাটে ওঠে, একটু টেনশন থাকলেও বেশ মজা লাগতো, যুদ্ধের দিনগুলোতে। দেশ স্বাধীনের পরে অটো প্রমোশনে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠে যায়। ক্লাস ফাইভে পড়া অবস্থায় গুণ অংক করতে পারতাম না, পরে বাবার প্যাদান খেয়ে বাবার কাছ থেকে সেটা শিখে নিই। ক্লাস ফাইভে ৮ জন প্রাথমিক বৃত্তি পরিক্ষা দেয়ার জন্যে নির্বাচিত হলো, দুর্ভাগ্য আমি সেই দলে ছিলাম না; মজার ব্যাপার হলো ঐ ৮ জনের কেউ বৃত্তি পায়নি।তবে সৌভাগ্য যে, আমি বাদে আমাদের প্রাইমারী স্কুলের কেউই পরবর্তীকালে মাস্টার্স শেষ করতে পারিনি।নিজ গ্রামের দুর্বাচারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছি ৫ম শেণি পর্যন্ত।
-
এরপর কুষ্টিয়ার শহরতলী (কুমারখালি উপজেলা) নানীর বাড়িতে থেকে প্রথমে কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়াস্থ মোহিনী মোহন বিদ্যাপীঠে পড়াশুনা করি এবং সেখানে অধ্যয়নরত ছিলাম ৯ম শ্রেনি পর্যন্ত। শহরের স্কুলেও যেয়ে প্রথম দিকে ভাল ফল লাভ করতে পারিনি। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে প্রথম সাময়িক পরিক্ষায় জাফর স্যারের অংকে ১০০ নম্বরের মধ্যে ০৫ নম্বর পেয়েছিলাম। এরপর সম্বিত ফিরতে শুরু করে, শহরের স্কুলের ছেলেরা আড়ালে আবডালে প্রকাশ্যে টিপ্পনী দিতে শুরু করলো।পরে পড়ায় একটু গতি সঞ্চারে ব্রতি হই, প্রাইভেট পড়া শুরু করি। শেষতক শহরের অনেক ভাল ছাত্রকে টপকিয়ে ক্লাস সিক্সে ফাইনাল পরিক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকারে সক্ষম হই।
- এবার পড়াশুনায় একটু গতি ফিরে আসে। নবম শ্রেণিতে আমার রুল নং ছিল ২।নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে ওঠার সময়ে ক্লাসে ফার্স্ট হই, আমার চিরচেনা অনেক দিনের ফার্স্ট বয় গৌতম কুমার স্যান্যাল ওরফে মাধব কে পেছন ফেলে। ডিপ্লোমা প্রকৌশলী মাধব ছাত্রজীবনে প্রেমজ কারণে বেশিদুর এগুতে পারিনি।পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা পড়ে কোন চাকুরি না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে করতে বছর দুয়েক আগে স্ত্রী ও এক মেয়ে সন্তানকে রেখে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে।
- ক্লাস নাইনে রেজাল্ট ভাল করার কারণে আমার ফুপাতো দুলাভাই, নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল(ঈশ্বরদী, পাবনা) ক্যাম্পাসের ভাল স্কুলে নিয়ে আমাকে পড়ানোর সদ্বিচ্ছা ব্যক্ত করে, আমার বাবাকে প্রস্তাব দেন। বাবা ইতিবাচক সাড়া দিলেও বাঁধ সাধেন মা! ফলে আমার আর পাকশিতে যাওয়া হয়নি। ওদিকে দুলাভায়ের ঐ নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলের গোটা পরিবেশের কথা শুনে দেহমনে চরম পুলকিত হই; স্কুলেও ঘোষণা দিয়ে দিই আমার বিদায়ের । কিন্তু না! সেটা হয়না! অগত্য স্কুল পরিত্যাগের চিন্তা বাদ রাখতে হয়. মনটা ভারি খারাপ হয়ে যায়। এরমধ্যে হঠাৎ খবর পাই কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে বিভিন্ন ক্লাসে কিছু নতুন ছাত্র ছাত্র ভর্তি করবে, তবে তার জন্যে সেখান তিন ঘন্টার পাক্কা লিখিত পরিক্ষা দিতে হবে; ওদিকে তখন জেলা স্কুলে পড়া মানে বিশাল একটা সামাজিক সম্মান !কা তব কান্তা, জেলা স্কুলে ভর্তির জন্যে দরখাস্ত করি, ইন্টারভিউতে ফার্স্ট হয়ে দশম শ্রেণিতে যেয়ে কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে ভর্তি হই, ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে। এটা বলতেই হয়, জেলা স্কুলের আপাদমস্তক সব ভাল ছাত্রদের সাথে তাল মেলাতে আমি আমার পড়ালেখার গতি আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলাম বলেই হয়ত প্রথম বিভাগে চার বিষয়ে লেটার মার্ক সহ ৭১৩ নম্বর পেয়ে এসএসসি(বিজ্ঞান) পাশ করি ১৯৭৮ সালে।জয়তু কুষ্টিয়া জেলা স্কুল!
- যথারীতি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ইন্টার ভর্তি হই, ১৯৭৮ সালে। ১৯৮০ সালে প্রথম বিভাগে ৬৪১ নম্বর পেয়ে এইচ এস সি( বিজ্ঞান) পাশ করি কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ থেকে।
এখানে বলে রাখি এসএসসিতে চার বিভাগে লেটার মার্ক সহ এসএসসি পাশ করার পরে বাড়ির সবাই আমাকে চিরায়ত নিয়মে ডাক্তারী পড়ানোর ইচ্ছে ব্যক্ত করেন।ইন্টারে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়ার পরে সবার এ ইচ্ছে আরো বেগবান হলেও আমি সেটা থেকে পিছিয়ে আসি। সে সময় আমি থাকতাম মামা বাড়িতে। আমার জনৈক মামা(মায়ের মামাত ভাই)তখন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে অধ্যায়নরত। মামা আমাকে বারবার মেডিক্যাল পড়াতে নিরুৎসাহিত করতেন। তার অন্যতম কারণগুলো ছিল: মেডিক্যাল পড়া কষ্টকর, মেডিক্যাল পড়াতে খরচ বেশি, ভাল চাকুরি নেই, ডাক্তারদের কোন ব্যক্তিগত লাইফ নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাহোক মামার উদ্বুদ্ধকরণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মেডিক্যাল পড়ার ইচ্ছে বাদ দিই, দরখাস্ত করা থেকে বিরত থাকি; শেষতক অভিভাবকদের চাপে পড়ে শেষ মুহুর্তে এক বড় ভাইকে দিয়ে দরখাস্ত করিয়েছিলাম কিন্তু সেখানে ছবি সংযুক্ত করতে ভুলের কারণে আমার দরখাস্ত বাতিল হয়ে যায়।তাতে অবশ্য আমি অখুশি হইনি।কারণ আমি দরখাস্ত করলে নিশ্চিত করেই যেকোন সরকারি মেডিক্যাল কলেজে চাঞ্চ পেতাম।আমাদের সময় প্রথমবারের মত এসএসসি ও এইচএসসিতে প্রাপ্ত মোট নম্বর ভিত্তিতে মেডিক্যালে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি করা হয়েছিল। মেডিক্যালে শুধু ১০ নম্বরের মৌখিক নম্বর ছিল।আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা স্কোর অনুসারে আমার পজিশন ছিল ৯২।
তবে আজকে আমি বেশ বুঝতে পারি, আমার সেদিনের সে সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আমি ডাক্তারি পড়লে ভাল ডাক্তার হতে পারতাম, কেন যেন আমার মনে হয়। আমার সেই মামা, ডা. আলাউদ্দিন আল আজাদ বছর দুয়েক আগে অর্থপেডিক কনসালটেন্ট হিসেবে তাঁর সরকারি চাকুরি শেষ করেছেন।
আমি কা্র্যত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু বুয়েটে চাঞ্চ পাইনি।আর দরখাস্ত করেছিলাম খুলনা ও রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে।আর চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আমাদের থেকে দুর হওয়ার জন্যে সেখানে আর দরখাস্ত করিনি।খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পরিক্ষা দিতে যাইনি কারণ তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শিক্ষার মান মোটেও সন্তোষজনক ছিল না। আর রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে তখন সেশন জট চলছিল এক বছরেরও বেশি। এর মধ্যে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকদিন পড়ার কারণে আর রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পরিক্ষা দিতে যাওয়া হয়নি।এখানে বলে রাখি এক সময় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়, Bangladesh Institute of Technology (BIT); তখন বলা হতো BIT খুলনা, BIT রাজশাহী, BIT চট্ট্রগাম। পরবর্তীতে BIT পরিবর্তিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয় এবং এসব প্রতিষ্ঠানের নাম হয়ে যায় Khulna University of Engineering & Technology (KUET); Rajshahi University of Engineering & Technology (RUET); Chittagong University of Engineering & Technology (CUET)ইত্যাদি।
এখন বলি, কৃষিতে পড়ার কথা। সে সময় আমাদের আশপাশের বেশ কয়েকজন সিনিয়র ছাত্র ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অগ্রজ আফজাল ভাই।আফজাল ভাই তখন ভেটেরিনারি(ডিভিএম) অনুষদে পড়তেন। তাঁর সাফ কথা ছিল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি অনুষদ বা ভেটেরিনারি(ডিভিএম) অনুষদে পড়লে নিশ্চিত একটা প্রথম শ্রেণির চাকুরি জুটবে।তাই শেষ পর্যন্ত ভর্তি হই ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদে।আফজাল ভাই বর্তমানে সরকারের যুগ্মসচিব হিসেবে কর্মরত।
এসব শুনলে এখনকার শিক্ষার্থী এটাকে পাগলের প্রগলভতা বা ঢপবাজি বলে মনে করবে।কিন্তু এর সবই তো নিরেট সত্য কথার সাতকাহন।
কৃষিতে পড়ার পরে অবশ্য নিজেকে সেখানে প্রথম প্রথম খুব বেশি এ্যাডজাস্ট করতে পারিনি; বন্ধুদের নিরন্তর কথার শর আমাকে আহত করতে থাকে, ফলে সেখানেও প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে ভাল ফল করতে পারিনি।তৃতীয় ও শেষ বর্ষ এবং মাস্টার্সে অবশ্য আমার রেজাল্ট ভাল ছিল।
যাহোক শেষ পর্যন্ত ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্বিদ্যালয় থেকে ২য় শ্রেণিতে বি.এসসি.এজি(অনার্স) পাশ করি ১৯৮৪ সালে (১৯৮৭ সালে অনুষ্ঠিত );
একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে (১৯৮৯ সালে অনুষ্ঠিত) ১ম শ্রেণিতে এম.এসসি(এজি) কীটতত্ব ডিগ্রী সম্পন্ন করি।১৯৮৬ সালের বিসিএস পরিক্ষায় অংশ করত: চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়ে ২০.১২.১৯৮৯ তারিখে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করি বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাট উপজেলার কৃষি অফিসে।
মাস্টার্স করার সময়ে অবশ্য আমার সুপারভাইজার প্রয়াত রেজাওয়ানুল হক স্যার আমাকে খুব পরিশ্রম করাতেন রিসার্চ করা ও থিসিস লেখার ব্যাপারে; সেজন্যে মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম আর কোন কোনদিন উচ্চতর ডিগ্রী করবো না; কিন্তু আমার সে অভিপ্রায় ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তবে আমার শ্রদ্ধাভাজন রেজাওয়ানুল হক স্যার পরিশ্রম করালেও উনি আমাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন এবং উনার কড়া অনুশাসন এবং স্নেহের পরশ না থাকেলে আমি মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেতাম না। সেজন্যে যার শেষ ভাল তার সব ভাল।স্যারের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।সাড়ে চার বছর চাকুরি করার পরে বিভাগীয় একটা বৃত্তি পেলাম সরকারি খরচায় পিএইচ.ডি করার। সেটারই ধারাবাহিকতায়, যুক্তরাজ্যের রেডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণ ও কারিগরী (পিএইচ. ডি কোর্সের অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের রেডিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Skill Development in Research Design(SDRD) বিষয়ের উপরে ০৬.১০.১৯৯৫-০৯.০১.১৯৯৬ তিন মাসের সার্টিফিকেটে কোর্স সম্পন্ন করতে হয়েছিল) সহায়তায় গাজীপুরস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কীটতত্ত্ব বিষয়ের উপরে উচ্চতর ডক্টরেট ডিগ্রী বা পিএইচ.ডি সম্পন্ন করি ১৯৯৯ সালের অক্টোবরের ১৮ তারিখে। সেখানে আমার রিসার্চ সুপাইভাইজার ছিলেন প্রফেসর ড. জিন্নাতুল আলম স্যার। স্যারের মানবীয় গুনাবলী অপার অপরিসীম! সেইসাথে স্যারের মেধা মননশীলা ছিল অন্য মাত্রার। স্যারের সম্পর্কে অন্যত্র ভাল কিছু একটা লেখার ইচ্ছে রইলো।
-
মোটামুটি এই হলো আমার শিক্ষা জীবন একখণ্ড চালচিত্র। আমার নিকটজনেরা আমাকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলেন বটে, তবে সেখানে ডাক্তার না হয়ে ডক্টর হয়েছি খারাপ কী? ভালই তো আছি!