স্মৃতিচারণমূলক লেখালেখি

  • এই অংশে আমি আমার স্মৃতিচারণশূলক লেখাগুলো লিখবো। আশা করি এখান থেকে নতুন কিছু তথ্য আপনারা পাবেন। প্রথমে আমি শিরোনাম লিখেবো এরপর ধারাবাহিকভাবে সিরিয়াল অনুসারে লেখাগুলো পাবেন।
  • (১) প্রথম ট্রেনে চড়ার স্মৃতি: সেটা ছিল ১৯৭৬ সালের ঘটনা বেশ মজা পাবেন আশা করি। এটি ২১.০৬.২০১৭ তারিখের লেখা:
  • (২) প্রথম সিংগাড়া খাওয়ার স্মৃতি: ঘটনাটা ১৯৭২ সালের। ২৩.০২.২০১৭ তারিখে লেখা

(১) প্রথম ট্রেনে চড়ার অমলিন ও বেদনাবিধুর স্মৃতি! সে কি ভোলা যায়?
দিন যায় কথা থাকে; সময় যায় স্মৃতির পাতা ভারি হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানব সন্তান মুখোমুখি হয় নানান অভিজ্ঞতার; নিজের নিউরনে সঞ্চিত হয় অম্ল মধুর স্মৃতিকথা! এসব স্মৃতিময় অনুভূতি কারুর কাছে পঁচা কাদার মত আবার কারুর কাছে চাঁদের আলো দিয়ে ঘেরা। অজ পাড়া গাঁয়ে বাস করে আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলার সময়ে আমাদের আবেগ অনুভূতি উচ্ছ্বাস খেলাধুলা আর বিনোদনের সাথে সে সময়ে যারা শহুরে পরিবেশে বড় হয়েছে তাদের মধ্য বিস্তর পার্থক্য ছিল। আমাদের ছোটবেলাতে গ্রামের রাস্তা দিয়া একটা মোটর সাইকেল গেলে আমরা দৌঁড়ে সেটা দেখতে যেতাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোটর সাইকেলের পেট্রোল পোড়া গন্ধ আমাদের কাছে ছিল সুবাসিত সৌরভের মত। ডিজিটাল প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের কাছে এটা এখন পাগলের প্রলাপ বৈ অন্য কিছু মনে হবে না।
ট্রেন দেখা ট্রেনে চড়া সে তো আমাদের কাছে একটা স্বপ্নিল ব্যাপার ছিল। তমসাবৃত রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ট্রেনের হুইসেলের শব্দ যখন শহর থেকে ১২ কিমি দক্ষিণাবর্তী কুষ্টিয়ায় সদরের প্রত্যন্ত দুর্বাচারা গ্রামে আমাদের কর্ণকুহরে পৌঁছাত, তখন সেটার আবাহনও আমাদের মনকে আবেগময় করে তুলতো, মোহাবিষ্ট হতাম কাঙ্খিত সেই স্বপ্নের রেলগাড়িতে চড়ার জন্যে। মন চাইলে তো আর রেলগাড়িতে চড়া হবেনা, তার জন্যে চাই একটা ভাল ভ্রমণসূচীর। সেটা আর হয়ে ওঠে না, তাই সেই কাঙ্খিত ট্রেনে চড়াও আর হয়না।এরই মধ্যে ১৯৭৩ সালের ০৬ ফেব্রুয়ারী ভর্তি হই কুষ্টিয়া শহরের মোহিনী মোহন বিদ্যাপীঠে ; তল্পিতল্পা নিয়ে মামার ছেলে প্রয়াত অগ্রজ আসলাম ভায়ের সাথে বসবাস শুরু করি কুষ্টিয়ার শহরতলী লালন মাজারের অদুরে ছেঁউড়িয়া মোল্লাপাড়ার বাঁশ বাগানের ঘন অরণ্যে ঘেরা মামা বাড়ির কানাস্তারা টিনের ছাউনি দেয়া ঘরের ছোট্ট একটা কক্ষে।

মামাবাড়ির দক্ষিণ পাশ দিয়ে চলাচল করে কুষ্টিয়া গোয়ালন্দের মধ্যকার রেলগাড়ী। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য মামাবাড়ি থাকা কালে ট্রেনের শব্দ পাওয়ার সাথে সাথে ঘর থেকে দৌঁড়ে বাড়ির বাইরে চলে আসি ট্রেন দেখতে। বৈকালিক ভ্রমনে যেয়ে বসি দবির মোল্লার রেলগেট সংলগ্ন রেলগেটের পাটাতনের উপরে আবার কখনো বা গার্ডশেডের লাউঞ্জে। সে সময় কখনো বা প্রিয় যানটির দৈবাৎ দেখা মেলে। স্কুলে যাবার পথে কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়া রেলগেট ক্রস করতে হয়, আবার স্কুলের ঠিক পূর্ব দিকে স্কুলের সীমানা প্রাচীর ঘেষে চলে গেছে গোয়ালন্দগামী ট্রেন লাইন। ফলে পাঠশালা এবং বসবাসের অবস্থা ও অবস্থানের কারণে সমসাময়িক কালে রেলগাড়ীর দরশন হামেশা মিললেও সেখানে আরোহণ করার সুযোগ আর হয়ে ওঠে না।

সবে ক্লাস এইটে পড়ি। গুরুগম্ভীর আর রাশভারি ইংরেজী শিক্ষক নীরেন স্যার পড়ানো শুরু করেন Robert Louis Stevenson এর লেখা From a Railway Carriage কবিতাটি। ১৮৮৫ সালে লেখা ছেলে ভুলনা ঐ কবিতার মধ্যে ট্রেনে চড়ে বাইরের দিকে তাকালে গাছপালা পাহাড় পর্বত আর নদী নালার নান্দনিক বর্ননা ছিল ঐ কবিতার মধ্যে। স্মৃতির খেরো খাতায় অবগাহন করে এখনো কবিতার বেশ কটি চরণ মনে করতে পারি:
“Faster than fairies, faster than witches,
Bridges and houses, hedges and ditches”.সাহিত্য প্রেমিক নীরেন স্যার বেশ মজা করে আমাদেরকে ঐ কবিতাটি পড়াতেন। কবিতা পড়ানো শেষের দিনে স্যারের কী মনে হলো, স্যার আমাদেরকে দরাজ কন্ঠে বললেন,”তোরা কে কে ট্রেনে চড়িসনি?” সামনের বেঞ্চে বসে আর ক্লাসের ভাল ছাত্রের তকমা পরে ক্যামনে বলি যে, স্যার আমিও ট্রেন চড়িনি।
তাকিয়ে দেখি পেছনে তিন আম আদমি সহপাঠী বন্ধু স্যারের ডাকা সাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এবারে মনে সাহস পেয়ে সলজ্জ্ব ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াতেই স্যার কন্ঠ ভারি করে সশব্দে বললেন,
” তুইও ট্রেনে চড়িসনি….?”।
আমাদের উদ্দেশ্যে স্যারের পরের বাক্য,
” আজই ২০ পয়সায় টিকিট কেটে কুষ্টিয়া স্টেশন থেকে কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশনে যাবি..।”
উল্লেখ্য কুষ্টিয়া শহরের মধ্যে ১.৫ কিমি ব্যবধানে দুটি পৃথক এবং পূর্ণাঙ্গ রেল স্টেশন আছে।

ট্রেনে তখন আমাদের কাছে যেমন একটা কাঙ্খিত যানবাহন ছিল, তেমনি প্রথমবারের মত ট্রেনে ওটা ভীতিকরও ছিল, কারণ যদি ভিড়ের মধ্যে সময়মত ওঠতে নামতে না পারি, কিভাবে টিকিট কাটতে হয়, কোন্ বগিতে কিভাবে উঠতে হয় এসব নানাবিধ শঙ্কা আর সংশয়ে পড়ে অভিজ্ঞ সঙ্গী না জোটার কারণে নীরেন স্যারের ট্রেনে চড়ার নির্দেশ প্রতিপালনে বছরাধিক কাল কেটে যায়।সবে নবম শ্রেণিতে উঠেছি, শীতকাল, প্রকৃতি ও তরুলতার পত্র পল্লবে তখনও ম্রিয়মানতা বিরাজমান রয়েছে। এরই মধ্য একদিন বিনে পয়সায় ট্রেনে চড়ার সুযোগ পেয়ে যায় দুর সম্পর্কের জনৈক অনুজ খালাত বোন মিনুর বদন্যতায়। মিনুর মামা বাড়ি আর আমার মামা বাড়ি একই সাথে। মিনু তখন সবে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে। মিনুর বাবা চাকুরি করেন রেলওয়েতে এবং ওদের পারিবারিক বসবাস পাকশী (পাবনা জেলা) রেলওয়ে কলোনীতে। মিনুর ছোট চাচা তখন কুমারখালি(কুষ্টিয়া) রেল স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। রেলওয়েতে বাবা চাচার চাকুরি করার কারণে পোষ্য কোটায় মিনুরা হামেশাই বিনে পয়সায় রেল ভ্রমণ করে থাকে।
এবার মিনুকে পটালাম আমাকে ট্রেন চড়ানোর জন্য। মিনু বিশাল কর্মযজ্ঞে তার সম্পৃক্ততা থাকছে জেনে এ প্রস্তাব সোৎসাহে গ্রহণ করে।

গন্তব্য ঠিক হলো সকালের ট্রেনে চেপে কুমারখালি যাব মিনুর চাচার বাসায়; অত:পর ফিরতি ট্রেনে দুপুরের মধ্যে আবার আমাদের গন্তব্য মামা বাড়ি ফিরে আসা।১৯৭৬ সালের জানুয়ারী মাস; কনকনে শীতের মধ্য কাকডাকা ভোরে তিন ট্রেন অভিযাত্রী, আমি ও আমার দু’বছরের ছোট মামাত ভাই ইব্রাহীম, কিশোরী মিনুর নেতৃত্বে পৌঁছে যাই কুষ্টিয়া রেল স্টেশনে। অত:পর মধ্যবর্তী চড়াইকোল স্টেশনে যাত্রা বিরতি শেষে সকাল ৮ টা নাগাদ মিনুর চাচার সরকারি বাসায় পৌঁছে যাই। এর মধ্য টিকিট চেকার একবার টিকিট চাইতেই স্মার্ট মিনু স্মার্টলি তার পৈতৃক পরিচয় দিতেই টিকিট চেকার আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। সফল পৈতৃক পরিচয়ে মিনু এবার আমাদের সামনে আরো গর্বিত হলো। ট্রেন ভ্রমনের অনাবিল আনন্দে মনের মধ্যে ফুরফুরে ভাব। কিন্তু মিনুর চাচার বাসায় ঢুকতেই শীতের চাদরে মোড়া তিন ক্ষুদে “ভিআইপি” মেহমান দেখে মিনুর সুন্দরী চাচী অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। সাদন্ত বেদনে মিনুকে একচোট নিয়ে নিলেন।
নিমেষেই আনন্দের ফল্গুধারা উবে যেয়ে মনের মধ্যে অমানিশার কালো মেঘ বাসা বাঁধল। ক্ষোভে দুঃখে আমরা সবাই হতভম্ব, কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
মিনুর অগ্নিদেবী চাচী প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্বেও আমাদের তিনজন কে কিঞ্চিৎ আলু ভাজি আর একখানা রুটি দিয়ে প্রাতরাশ খেতে দিলেন। অথচ আমাদেরই সামনে মিনুর চাচা সেরে নিলেন এক জম্পেশ প্রাত: সেবা।
কোনমত আমাদের দেয়া খাবার গলধকরণ করে নিরাপদে নির্ধারিত সময়ের আগেই দ্রুত আবার স্টেশনে চলে আসি। ফিরতি ট্রেনে যথারীতি দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যায় যে যার ঢেরায়।
সাঙ্গ হলো জীবনের প্রথম ট্রেন ভ্রমনের কাহিনী।

১৯৭৬ থেকে ২০১৭ সাল; এরমধ্যে কেটে গেছে ৪১ টি বছর; সেই ট্রেন তেমনই আছে, আছে সেই স্টেশন, মাঝে সেটার গড়নে ও গঠনে কিছু পরিবর্তন এসেছে। ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম খ্যাত’ কয়লা চালিত রেল ইঞ্জিন স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে; খয়েরী রংয়ের মেইল ও লোকাল ট্রেন প্রতিস্থাপিত হয়েছে লাল সবুজের আবরণে মোড়া বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেনের মাধ্যমে; সংযোজিত হয়েছে ট্রেনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলাচলের বাঁধাহীন করিডোর আরো কত কী??!
ওদিকে সেদিনের সেই গেঁয়ো ভূত ছেলেটি উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ সনদ লাভ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; পদায়িত রয়েছে সরকারের ক্যাডার সার্ভিসের উচ্চতর পদে।চার দশকেরও অধিক সময় পরে ট্রেনে চড়তে গেলেই অবচেতন ভাবেই মনে পড়ে প্রথম ট্রেনে ভ্রমনের স্মৃতিকথা, স্মার্ট মিনুর স্মার্টনেসের কথা, মিনুর চাচীর অমানবীয় শালীনতা বর্হিভূত আচরণের কথা, ওর চাচার দাম্ভিকতার কথা! অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল মিনুর সাথে দেখা করে ওকে নিয়ে ওর চাচার বাড়িতে যেয়ে ওর চাচা চাচীরা বেঁচে থাকলে তাঁদের মুখোমুখি হয়ে নিজের অবস্থানটা জানান দিয়ে আসা যে, সেদিনের সেই সাধারণ সাজ পোশাকে মোড়া অস্পৃশ্য সাধারণ ছেলেটি স্বীয় যোগ্যতায় অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে সাফল্যের সোপান বেয়ে আজ অনেকদুর এগিয়েছে।এমনই একটা ভাবনার বৈতরণী পার হতেই না হতেই আকস্মিকভাবে ক’দিন আগে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন মিনুর অকাল প্রয়াণের খবর শুনে একেবারে হত বিহবল হয়ে গেলাম। বছর তিনেক আগে দুরারোগ্য কর্কট রোগের কবলে পড়ে মিনু আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। মিনুর অকাল প্রয়াণের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ব্রেইন এ্যাটাকে মারা গেছে ওর পতি প্রবর। মিনুর ছেলে মেয়েরা এখন বড্ড অসহায় আর ইয়াতিম হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।স্কুলের চৌহদ্দি পেরুনোর আগেই মিনু সংসারী হয়ে বসবাস করত কুষ্টিয়া শহরের উপকন্ঠে। মোটাভাত মোটা কাপড় আর আটপৌরে জীবনে অভ্যস্থ মিনু স্বামী সন্তান নিয়ে ভালই ছিল, কিন্তু নিয়তির অমোঘ বিধানে ও বড্ড অসময়ে চলে গেল। আমার জীবনে অনাবিল স্মৃতির সঞ্চয়কারী মিনুর সাথে এ জীবনে আর কোনদিনও দেখা হবে না। মিনু কোনদিন জানতেও পারবে না, ওকে নিয়ে আমার লেখা এই স্মৃতির মালার কথকতা!!
১৯৮০ সালের পরে মিনুর সাথে আমার আর কোন সাক্ষাত দর্শন হয়নি। দুরালাপনেও হয়নি কোনদিন কোন কথা!!
এসব স্মৃতিকথা লিখছি আর ভাবছি How uncertain our life is!
মানুষ ভাবে এক আর নিয়তি নিয়ে যায় আরেক গন্তব্যে।
আসা যাওয়ার এই যাত্রা পথে ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়াতে আমরা শুধু একটুখানি যাত্রা বিরতির সুখ ভোগ করছি মাত্র! মিনু চলে গেছে, আমরা ওর পথের দিকে চেয়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, অপেক্ষা করছি ভবনদীর ওপারে যাবার ট্রেনে ওঠবার জন্যে। ঘন্টা পড়লেই আমরা উঠে যাব, মিনুকে বহনকারী ট্রেনে, পেছনে পড়ে রবে একরাশ স্মৃতিকথা, অশ্রুজলে দৃশ্যমান শেষ বিদায় জানাবে প্রিয়জনেরা। একদিন মিনুর মত স্মৃতির অতলান্তে হারিয়ে যাব আমরাও, তখন আমাকে বা আমাদের মত কাউকে নিয়ে হয়তবা কেউ একদিন লিখবে স্মৃতি বিজড়িত এমনি এক আবেগময় ব্যঞ্জনার সাতকাহন, আমাদের ফেলে যাওয়া জীবনের আরেক নামাবলী “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ”!

(২) স্বাধীন দেশের প্রথম ফাগুনে জীবনের প্রথম সিঙ্গাড়া খাওয়ার অমলিন স্মৃতি!
সে কী ভোলা যায়?

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ এবং দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সবে সম্মানিত ও গৌরবান্বিত হয়েছি। অনেকের প্রিয়জন হারানোর ব্যথা মনে থাকলে শোকাবহ স্মৃতি হয়ে উঠেছে শক্তির মূর্ত প্রতীক। ওদিকে প্রকৃতি তার আপন রূপ রস গন্ধ নিয়ে স্ব-মহিমায় এগিয়ে চলেছে। শীতের সজীবতায় জুবুথুবু প্রকৃতি সতেজ হতে শুরু করেছে। কোকিলের কুহুতান, বসন্তের আমেজ, সতেজ আবহাওয়ার মিষ্টতা, শিমুল পলাশ সহ নাম না জানা ফুলের সৌরভ, আম্র মুকুলের মৌ মৌ গন্ধ সব মিলিয়ে প্রকৃতি ও মানুষের মন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।সেই সাড়ে চার দশকের প্রকৃতি আজও তেমনি অাছে, মনুষ্য সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি আর মানব অত্যাচারে সেটার প্রতিফলনে একটু বদল হলেও প্রকৃতির মূলধারা তেমনি অটুট রয়েছে। প্রকৃতি আজএ তেমনই আছে, পরিবর্তন হয়েছে আমাদের জীবন মানে।বিনা পরিক্ষা আর বিনা পড়ালেখায় চার ক্লাস থেকে পাঁচ ক্লাসে উঠে গেছি, কিন্তু পড়ালেখার চাপ নেই, কারণ নতুন বইপত্র তখনো হাতে এসে পৌঁছাইনি। বয়সগত কারণে দেশ স্বাধীনের ফলে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির কোন হিসেবও আমার মাথায় নেই। সবার মত আমিও আছি মহাসুখে। খাই দাই গরু চরাই,বাবার দোকানে কামলা বাই।

ঊনসত্তরের গণ অভ্যূত্থানের উত্তাল দিনে কোন এক শুভক্ষণে ৩রা মার্চ, সোমবার বিয়ে হওয়া মেজ ভাবীর মেহেদীর রাঙা আভা মিলিয়ে গেলেও তখনো মনে রয়েছে বাসন্তীর উষ্ণ পরশ। ভাবীর ইচ্ছে হলো বাড়ির সবাই মিলে একদিন সিঙ্গাড়া খাবে। মেজ ভাবী আর্জি তুললেন বাবার কাছে, বাবা মঞ্জুরিপত্র দিলেন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেন বাড়ির সবাইকে একটা করে সিঙ্গাড়া খাওয়ানোর।
তবে সেটা বাড়ি থেকে ১৩ কিমি দুরবর্তী দুর্গম রাস্তা মাড়িয়ে বাই সাইকেলে চেপে নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়লো আমার নোয়াভাইয়ের (চার নম্বর ভাই) উপরে।সিঙ্গাড়া প্রসংগে একটা বলতেই হয়, আমরা যারা তখন গাড়াগাঁয়ে থাকি সেখানে সিঙ্গাড়া আমাদের কাছে এক দিল্লিকা লাড্ডুর মত ছিল। যারা শহরে যান তারা চার আনা দামের সিঙ্গাড়া নামক অমৃত খেয়ে এসে আমাদের সামনে রসিয়ে রসিয়ে গল্প দেন, গল্প শুনে আমাদের জিহবা থেকে ঝর্ণা ধারা বইতে থাকে।বেশ মনে আছে সবে ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে প্রথম সাড়ম্বরে মহান একুশে পালন করেছি। অজ গ্রামের মধ্যেও সেদিন প্রভাত ফেরিতে শত শত ছাত্র ছাত্রী আবাল বৃদ্ধ বণিতা আমাদের স্কুল (কুষ্টিয়া সদর উপজেলার দুর্বাচারা প্রাইমারি ও হাইস্কুলের যৌথ উদ্যোগে) থেকে ৩/৪ কিমি দুরবর্তী করিমপুর গ্রামে আমাদের গ্রামের অন্যতম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শহিদ ভায়ের শাহাদৎ স্থলে যেয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছিলাম। করিমপুরের যুদ্ধে রাজাকারদের আচমকা আক্রমনে শহিদ ভাই শহীদ হন ০৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ।ঘটনাটি ১৯৭২ এ একুশ পালনের এক বা দুদিন পরের হবে ; চাচীকে তাঁর বাবার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে। ঐ সময় গ্রামের প্রথাগত নিয়মানুসারে ছৈ ঘেরা ঘোড়ার গাড়ীই ছিল নববধূদের নায়রের এবমাত্র বাহন। ঘোড়াগাড়ীর সাথে রাহাবার হিসেবে সাধারণত: কোন কিশোর বালককে পাঠানো হতো। সে মোতাবেক চাচীকে বাবার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে আনার রাহাবারের দায়িত্ব পড়ে আমার উপরে। উল্লেখ্য এই চাচীর বিয়ে হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে। যে বিয়েতেও দাদার সহকারী হিসেবে আমার সরব উপস্থিতি ছিল।যাহোক যেদিন চাচীকে আনতে যাই তার আগের দিন সন্ধ্যায় বহু কাঙ্খিত একখানা সিঙ্গাড়া হাতে পেয়ে যায়। শুধু আমি নই, বাড়ির সবাই যারা খাওয়া শিখেছে তাদের প্রত্যকে একটা করে সিঙ্গাড়া বরাদ্দ দেয়া হয়। মজা করে কখন কিভাবে সেটা গলধকরণ করবো, ঠিক করতে নাকাল হচ্ছিলাম কারণ ঐ অমৃত সিঙ্গাড়া খাবার সাথে সাথেই তো কেল্লা ফতে, সব মজা শেষ হয়ে যাবে। তাই রাতে না খেয়ে সেটা মাথার কাছে নিয়ে ঘুমালাম। ভোরবেলা উঠে নাস্তা খেয়ে হাফপ্যান্টের পকেটে সিঙ্গাড়া নিয়ে চাচীর বাবার বাড়ি গেলাম। যাবার পথে ঘোড়াগাড়ী চালক সবা চাচাকে একবার পকেট হতে সিঙ্গাড়া বের করে দেখালাম। সবা চাচা বললেন তিনি সিঙ্গাড়া খেয়েছেন, বেশ সুস্বাদু।চাচী বাড়ি যেয়ে দুপুরে ডিম রান্না তরকারি দিয়ে ভাত খেলাম। তখনো সিঙ্গাড়া খাওয়া হয়নি। এবার চাচার শ্বশুরবাড়ির আশপাশে আমার সম বয়সী কিছু ছেলে মেয়েকে বেশ ভাব নিয়ে সিঙ্গাড়াটা পকেট থেকে বের করে মাঝে মাঝে দেখাচ্ছি। বলে রাখি সে সময় চাচীর বাবার বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আরো দুর্গম এবং অনুন্নত গ্রাম ভবানীপুর; ফলে ওসব গণ্ডমূর্খ বালক বালিকাদের কাছে আমাদের অবস্থান কিঞ্চিত উপরে।
এবার এক পর্যায়ে সম্বিত ফিরে বু্ঝতে পারলাম ঐ গ্রামের বখাটে ছেলে মেয়েরা আমার অমৃত হাইজ্যাক করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পরিস্থিতির সম্ভাব্য পরিণাম এবং ভয়াবহতা উপলব্ধি করে দ্রুত পাশের বিশাল আয়তনের আম্র বাগানে প্রবেশ করলাম, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার বাহানা করে। প্রকৃতির ডাক বালাই ষাট! বাগানে ঢুকে চারদিকে মনুষ্য নির্গত নতুন পুরানো প্রাকৃতিক বস্তুর নিষিদ্ধ সৌরভের মধ্যেই দ্রুত গিলে ফেললাম অমৃত সম সিঙ্গাড়াটি। আহ সে কী স্বাদ! মনে হলো এমন অমৃত জীবনে খাইনি।

এবার হাইজ্যাকাররা আমার চালাকিতে হতভম্ব হলো বটে কিন্তু ওদের কিছু করার ছিলনা। সেদিন সিঙ্গাড়া খাওয়া শেষে সন্ধ্যার প্রক্কালে গোধূলির নৈসর্গিক অাবহাওয়ায় চাচীকে নিয়ে ফিরে এলাম নিজ পিত্রালয়ে।
শেষ হলো আমার জীবনের প্রথম সিঙ্গাড়া খাওয়ার উপাখ্যানের রসালো আর মজাদার সাতকাহন।
বড় হয়ে এখন আর সিঙ্গাড়া খেতে ভাল লাগে না, তবে সামনে সিঙ্গাড়া দেখলেই মনে পড়ে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ প্রহরে সিঙ্গাড়া খাওয়ার স্মৃতিকথা। সে তো এক অমলিন স্মৃতি সে কী ভোলা যায়? কারণ সে স্মৃতি তো আমার অন্তরাত্মার অংশ হয়ে মিশে আছে আমার হৃদ মাঝারে!